বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর হাত ধরে এবার প্রাণিজগতে যোগ হলো আরো দুই নতুন অমেরুদণ্ডী প্রাণী। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) মৎস্য ও সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. বেলাল হোসেন এই প্রাণী দুটির সন্ধান পেয়েছেন।
১৪ মে বায়োটেক্সা জার্নালে প্রকাশ হয় Neumania nobiprobia (নিউমেনিয়া নোবিপ্রবিয়া) ও Arrenurus smiti (অ্যারেনুরাস স্মিটি) নামের নতুন প্রাণী দুটির নাম। এর মধ্যে নিউমেনিয়া নোবিপ্রবিয়া নামটি নোবিপ্রবির নামে নামকরণ করা হয়। আর ‘অ্যারেনুরাস স্মিটি’র নামকরণ করা হয় নেদারল্যান্ডসের বিখ্যাত একারোলজিস্ট হ্যারি স্মিথের নামে।
এবারের এই গবেষণাকর্মে ড. বেলাল হোসেনের সহ-গবেষক হিসেবে ছিলেন মন্টেনিগ্রোর প্রখ্যাত একারোলজিস্ট ড. ভ্লাদিমির, ভারতের ক্রিসেন্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রফেসর তাপস চ্যাটার্জি, পোল্যান্ডের শেচিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. আন্দ্রজেল জয়েল এবং তার ছাত্র মো. সাইফুল ইসলাম।
গতকাল রোববার নোবিপ্রবি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, প্রজাতি দুটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের জন্য গবেষণার ফল যুক্তরাজ্যের লন্ডন ও নিউজিল্যান্ড থেকে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী ‘সিস্টেমেটিকস’ ও ‘একারোলজি’তে পাঠানো হয়। এছাড়া প্রজাতি দুটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে নিউজিল্যান্ড থেকে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক জার্নাল বায়োটেক্সায় (biotaxa.org) পাঠানো হয়। গত ১৪ মে গবেষণাটি ওই জার্নালে প্রকাশও হয়। একই দিন বিশ্ব স্বীকৃত ডাটাবেজ Zoobank (জুব্যাংক)-এ অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মাধ্যমে এগুলো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে।
নোবিপ্রবির গণসংযোগ কর্মকর্তা ইফতেখার রাজু জানান, ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত ড. বেলাল হোসেন নোয়াখালীর বিভিন্ন পুকুর, খাল ও নদী থেকে মাইটসের নমুনা সংগ্রহ করেন। এতে সঙ্গী হন তারই ছাত্র নোবিপ্রবির মৎস্য ও সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের মো. সাইফুল ইসলাম। উপকূলীয় জেলা নোয়াখালী থেকে সংগৃহীত নমুনা প্রথমে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য ও সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের ল্যাবে শনাক্ত করার পর ফলাফলের জন্য মন্টেনিগ্রোতে গবেষক ড. ভ্লাদিমিরের কাছে পাঠানো হয়। তিনিই নমুনাগুলো চূড়ান্তভাবে শনাক্ত করেন ও সিদ্ধান্তে উপনীত হন।
প্রাণিজগতের আর্থোপোডা পর্বের একারিয়া বর্গের অন্তর্গত প্রাণী দুটি অত্যন্ত ছোট এবং দেখতে কিছুটা ছোট মাকড়সার মতো। এরা মাইটস নামে পরিচিত। সাধারণত পুকুর, নদী বা খালের পানির ওপরের স্তরে ভাসমান উদ্ভিদের সঙ্গে এরা ঝুলে থাকে। আকার ২ থেকে ৩ মিলিমিটার এবং হালকা লাল ও হলুদ বর্ণের হয়। খাবার হিসেবে গ্রহণ করে উদ্ভিদকণা। তবে লার্ভা অবস্থায় এরা অন্য জলজ প্রাণীর দেহে পরজীবী হিসেবে বাস করে এবং তাদের থেকেই খাবার সংগ্রহ করে। এরা জীবজগতের খাদ্যচক্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এ সম্পর্কে ড. বেলাল বলেন, স্থলজ মাইটস নিয়ে গবেষণা হলেও জলজ মাইটস নিয়ে এই প্রথম বাংলাদেশে কাজ হলো। আমাদের উপকূলীয় বা সামুদ্রিক অঞ্চল অত্যন্ত জীববৈচিত্র্যপূর্ণ। গবেষণার অপ্রতুলতার কারণে এ দেশের জীববৈচিত্র্যের সম্পূর্ণ তালিকা এখনো তৈরি করা সম্ভব হয়নি। এ পর্যন্ত আমি যতটুকু গবেষণা করেছি তা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও নিজস্ব অর্থায়নে।
তিনি বলেন, প্রাণিজগতের প্রতিটি প্রাণীই ইকোসিস্টেমে তথা খাদ্যচক্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। এদের একটির অনুপস্থিতিতে খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়ে। ফলে ইকোসিস্টেম তার স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে পারে না।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য নিয়ে আরো ব্যাপক আকারে গবেষণা সম্ভব বলে মনে করেন এ সমুদ্রবিজ্ঞানী।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে দুটি অমেরুদণ্ডী প্রাণীর সন্ধান দিয়ে আলোচনায় আসেন সমুদ্রবিজ্ঞানী ড. মো. বেলাল হোসেন। সে সময় বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে Nephtzs Bangladeshi (ন্যাফটাইস বাংলাদেশি) নামে পলি-কীটের নতুন একটি প্রজাতি এবং দেশের বাইরে ব্রুনাইয়ের উপকূলীয় এলাকা থেকে Victoriopisa bruneiensis (ভিক্টোরিওপিসা ব্রুনেইয়েনসিস) নামে আরেকটি নতুন প্রজাতির পলি-কীটের সন্ধান দেন ড. বেলাল।